মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ, ২০১৩

'মাতৃত্ব' ছোটগল্প

 
মাতৃত্ব
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়

--- আমি মা হতে চেয়েছিলাম। শুধু নিজের সন্তানের মা। বিশ্বের সকলের মিথ্যে মিথ্যে মা হতে চাইনি আমি। আমি একটা সংসার চেয়েছিলাম, স্বামী চেয়েছিলাম। এটা কি এক নারীর পক্ষে বেশী কিছু চাওয়া? কিন্তু এরা আমাকে জগজ্জননী বানিয়ে আমার সব চাওয়া-পাওয়া নষ্ট করে দিয়েছে। আমি যে কথা বলতে চেয়েছি, তা কেউ শোনেনি। আমাকে আমার কথা বলতে না দিয়ে এদের বানানো কথাগুলো আমার মুখে বসিয়ে আমাকে নিয়ে এরা মা মা খেলেছে। আমি এরকম নিঃসন্তানা মা হতে চাইনি।
আদালতে উপস্থিত সকলকে চমকে দিয়ে এই কথাগুলো বললেন ভক্তদের বিগত সত্তর বছরের শ্রদ্ধেয়া মা কল্যাণেশ্বরী। আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো পক্ককেশ, লোলচর্ম, অশিতীপর বৃদ্ধা। কম্পমান তাঁর শরীর, অস্থিচর্মসার তাঁর স্বাস্থ্য। দুর্বল পায়ে এক তরুণের কাঁধে ভর করে কাঠগড়ায় এসে উঠেছেন, আর দড়ির মতো পাকানো হাতে কাঠগড়ার রেলিং ধরে নিজেকে দাঁড় করাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। আজ প্রথম মা কল্যাণেশ্বরী তাঁর মনের কথা, তাঁর প্রাণের কথা সর্বসমক্ষে জানাতে এসেছেন। মানুষকে, বিশেষত প্রভু জগদ্বন্ধু ঠাকুরের আশ্রমিক ও ভক্তদেরকে তিনি জানাতে এসেছেন যে, তারা যেমনটি মা বলে তাঁকে চেনে, তিনি তাদের তেমনটি নন। তেমনটি হবার কোনো ইচ্ছে বা শক্তি তাঁর কোনোদিন ছিলো না, আজও নেই। মুখে বলা সন্তানদেরকে দেবার মতো তাঁর কাছে অন্য যে কোনো সাধারণ নারীর মতই কিচ্ছুটি নেই। তিনি কোনোদিন গর্ভধারণ করতে পারেননি এবং তাই মা-ও হতে পারেননি। তিনি মনে করেন, মানুষের নিজের মা থাকতে এমন মা হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তার জন্যে যে অপারতা থাকা উচিত, নিঃস্বার্থ অপত্যস্নেহ থাকা প্রয়োজন, তা থাকে কেবল গর্ভধারিণীর। মাতৃত্বের কোনো স্বাদ তিনি কখনও পাননি। মা তিনি দেখেছেন, কিন্তু মায়ের ভালোবাসার আস্বাদ তাঁর কাছে অজ্ঞাত। এমনকি তাঁকে জন্ম দিয়েই তাঁর গর্ভধারিণী সুতিকারোগে প্রাণ দিয়েছিলেন। তাই আজ এই বিশ্বজননীর সোনার খাঁচা থেকে তিনি মুক্তি চান। জীবনের শেষকটা দিন নিজের মতো করে তিনি বাঁচতে চান। তিনি আর এই মা মা খেলায় নেই।
সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় প্রথম কলামে বড়ো বড়ো হেডলাইনে স্থান পাবার মতো চমকপ্রদ এই জবানবন্দী আজ শুনছেন নদীয়ার জেলা দায়রা আদালতের স্বয়ং প্রধান বিচারক, আর আদালতে উপস্থিত আশ্রমের সকল মানুষের মতোই তিনি বিস্ময়ে হতবাক হচ্ছেন। হয়তো এই জবানবন্দীর মাধ্যমে মা কল্যাণেশ্বরীর এই প্রথম নিজের পায়ে দাঁড়াবার প্রচেষ্টা। নিজের স্বামী গুরু পরমপুরুষ জগদ্বন্ধু ঠাকুরের দেহান্তরের পর এইকথা অনেকবার তিনি আশ্রমের তথাকথিত ভক্ত সন্তানদেরকে বলেছেন। কিন্তু তারা মায়ের কথাকে সাময়িক মানসিক বিকার বলেই গুরুত্ব দেয়নি। তাই আজ এই কথাগুলো বলতে বলতে আর চোখের জল মুছতে মুছতে বাংলার নমস্যা বন্দিতা আর পাপী-পুণ্যাত্মা-ভালো-মন্দ-উচ্চ-নীচ সকলের পরম আরাধ্যা অশীতিপর মা কল্যাণেশ্বরী আদালতকে মাধ্যম করে বিচারকের সামনে নিজের এ্যাতোকালের জমে থাকা বেদনা, কষ্ট আর হতাশা নিবেদন করেছেন। তিনি মুক্তি চান।
আদালত ভর্তি মানুষ। প্রশাসন তাদেরকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। আদালতের বাইরে বাংলা হিন্দি ইংরেজি নানা সংবাদ মাধ্যম তাদের আলোকচিত্রি আর শব্দ গ্রহণের সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ছে। কিন্তু আদালতের অনুমতি না থাকায় তারা ভেতরে প্রবেশ করতে পারছে না। কিন্তু তারা সকলেই মায়ের কষ্ট জানতে চায়, সেই কষ্ট জনসাধারণকে জানাতে চায়। এই সন্‌সনি খবর বাজারে বেচতে চায়। যারা মা কল্যাণেশ্বরীকে আর তাঁর সদ্য মহাপ্রয়াণ প্রাপ্ত স্বামী গুরু পরমপুরুষ জগদ্বন্ধু ঠাকুরকে এ্যাতোকাল অন্তরের সকল শ্রদ্ধা আর আর্তি জানিয়ে এসেছে, তারা আজ তাদের সেই বিশ্বেশ্বরী মায়ের এমন মানসিক বিকারে স্তম্ভিত, বিস্মিত এবং ভগ্নপ্রায়। তাদের কারোর চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে, কেউ কপালে করাঘাত করছে, কেউ বা এই ঘটনায় কোনো বিদেশী শক্তির প্রভাব দেখতে পাচ্ছে। তারা হতবাক। তাদের পরম পূজনীয়া মা আজ এ কী বলছেন! এমনটা তারা কোত্থাও কোনোকালে শোনেনি। এমনটা কি কোথাও কখনও ঘটেছে, না ঘটতে পারে! আজ এ্যাতোকাল ধরে তারা গুরু পরমপুরুষ জগদ্বন্ধু ঠাকুরের গুরুধামে বছরে একবার তো অন্তত পুজো দিতে আসছে। অনেকে আসে বছরে দু থেকে তিনবার। আশ্রমের দীক্ষিত শিশ্যদের মধ্যে অনেকেই যথেষ্ট বিত্তশালী, প্রভাবশালী আর রাজনৈতিক ক্ষমতাশালীও বটে। ফলে তাদের থেকে নানা উৎসপথে যথেষ্ট ভালোমন্দ প্রণামী আশ্রমে জমা পরে। তাদের অনেকেই তাদের সরকারী হিসেব বহির্ভূত অর্থ রং পরিবর্তনের অভিপ্রায়ে মুঠো মুঠো করে এই আশ্রমে বা এমন আরো নানা আশ্রমে, মন্দিরে, মসজিদে, গুরুস্থানে দান করে থাকে, আর সেই অর্থে ভক্তসেবাও হয়। এসব বিষয় নিয়ে কেউ আজকাল ভাবে না। সরকারও মানুষকে এমন অর্থের বিনিময়ে কোনো প্রকার রাজস্ব থেকে মুক্তি দিয়ে থাকে। ভক্তেরা সকলেই গুরুদেবের এই জন্মস্থানেই বিপুল বিস্তৃত দেড়শ কক্ষসম্বলিত দ্বিতলবিশিষ্ট অতিথিশালায় বসবাস করে। ঠাকুরের জন্মদিনের পুণ্যতিথিতে  প্রয়োজনে তাঁবু নির্মাণও করতে হয়। আশ্রমের পাশেই বয়ে যাচ্ছে নদী, ভক্তেরা সেই নদীতে অবগাহন করে, আশ্রমেই পঙক্তিভোজনে উদরপূর্তি করে, সকালে সন্ধ্যায় গুরুদেবের সাধন কক্ষে সন্ধ্যা-আহ্নিক করে, আবার যে যার সংসারে ফিরে যায়। তবে যারা বিশেষ দানী, তাদের জন্যে পৃথক এবং অধিক যত্নসম্বলিত অতিথি গৃহ আশ্রমে আছে। তারা সেখানে অবস্থান করে।
আজ তারা কেউই বুঝতে পারে না, কী অভাব ছিলো মা কল্যাণেশ্বরীর! এ্যাতোকাল তো তিনি নিজেকে ভক্তের প্রকৃত মা হিসেবেই পরিচয় দিয়ে এসেছেন। তিনি নিজেই তো সন্তানদের কাছে বলতেন, গর্ভধারণ একপ্রকার মাতৃত্ব। তাতে মাতৃত্ব সম্পূর্ণ হয় না। মা নারীর ডাকনাম পর্যন্ত নয়। মায়ের কাজই মায়ের পরিচয়। তবেই সে হয়ে ওঠে আসল মা। গর্ভধারণ একটা উপায় মাত্র। এমনই তো মা ছিলেন তিনি। মা হিসেবে সন্তানদের যে পুজো তিনি এ্যাতোকাল গ্রহণ করে এসেছেন, তা গুরু পরমপুরুষ জগদ্বন্ধুর ঠাকুরের মহাপ্রয়াণের পরই বা কেন বিস্বাদ লাগলো! আজ এই এ্যাতো বড়ো আশ্রম, এ্যাতো ভক্তসমাগম, এমন সাধন-ভজন--- সবই যে জলাঞ্জলি যায়। নির্মূল হয়ে যাবে এই আশ্রম। অথবা অসৎ মানুষের হাতে পড়ে বিনষ্ট হবে এর সুনাম সুখ্যাতি। অথবা মেদিনীপুর, নদীয়া আর বর্ধমান জুড়ে যে আশ্রমের এই বিপুল সম্পত্তি--- সবই যে সরকারের হাতে বেওয়ারিশ করার পেয়ে বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে! এসবের তো কোনো মাহাত্ম্য আর থাকছে না মা কল্যাণেশ্বরী দেবীর এমন জবানবন্দীর পর। তিনি নিজেই তো আদালতে আর্জি জানিয়ে আজ এই বিবৃতি দিচ্ছেন। কেন তবে এই মতিভ্রম!
একটু পেছন তাকালেই জানা যাবে, এই গুরু জগদ্বন্ধুর আশ্রম একদিনে গড়ে ওঠেনি। এর পশ্চাতে আছে ঠাকুরের প্রতি বহু মানুষের অন্তরের ভক্তি, কায়িক প্রচেষ্টা, একটু একটু করে সংগৃহীত অর্থ। গুরু পরমপুরুষ জগদ্বন্ধু ঠাকুর ছিলেন ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। পৌরোহিত্য ছিল এই গোস্বামী পরিবারের পৈত্রিক জীবিকা। গ্রামজোরা নাম ছিলো এই যজমানী পরিবারের। কিন্তু জগদ্বন্ধু তাঁর শিশু বয়স থেকেই নিজের চাল-চলনে একটা ব্যতিক্রমী ভঙ্গিমা প্রকাশ করছিলেন। ঐহিক নানা বিষয়ে তাঁর এক অনীহা পরিলক্ষিত হয়। ব্রাহ্মণ পরিবার। তাই স্বভাবতই বাবা বা বড়ভাই-এর সাথে গ্রামে যজমানদের বাড়িতে যাওয়া, নানা উপচারে নানা দেবদেবীর পুজো চলাকালে পাশে বসে বসে পুজো প্রত্যক্ষ করা তাঁর শিশু বয়স থেকেই অভ্যাস ছিল। এমনভাবেই অনুজদেরকে পৈতৃক জীবিকায় হাতেখড়ি দিয়ে থাকে পরিবারের অগ্রজরা। তেমনভাবেই এই গোস্বামী পরিবারের অগ্রজরা বালক জগদ্বন্ধুকে পৌরোহিত্যে কাজে হাতেখড়ি দিচ্ছিলেন। কিন্তু জ্ঞান হবার পর থেকেই তাঁর মধ্যে পারত্রিক বিষয়গুলো অর্থাৎ ঈশ্বর প্রীতি, সাধন-ভজন এক সঙ্গত কারণে প্রকট হয়ে দেখা দিলেও কোথায় যেন সকলের থেকে পৃথক সত্তায় দেখা দিচ্ছিলেন গুরু পরমপুরুষ জগদ্বন্ধু ঠাকুর। বাল্য বয়স থেকে তাঁর মধ্যে পৈত্রিক জীবিকা তো বটেই, এমনকি প্রতিদিনকার খাদ্যাখাদ্য, মানুষের স্বাভাবিক ধর্মকর্ম কোনোকিছুই স্বাভাবিকভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। বরং গার্হস্থ্য জীবন, শারীরিক নিরাপত্তা অথবা স্বাভাবিক জীবনের প্রতি একটা অনীহা তাঁর ছিল। তাঁদের পরিবারে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন বিস্তারলাভ না করলেও শিক্ষার সাথে যেটুকু সম্পর্ক জগদ্বন্ধুর পিতৃ-পিতামহের ছিল, তাঁর ছিটেফোঁটা আগ্রহ ছিল না এই বালকের। কিন্তু বিস্ময়করভাবে ছোটবেলা থেকেই মানুষের জীবন ও জীবনবোধের অনেক সাধারণ আর স্বাভাবিক বিষয়, যা মানুষ সহজে মেনে নিতে পারে না, তাঁর প্রতি জগদ্বন্ধুর এক দুর্নিবার আকর্ষণ ছিলো। এমনকি পিতার দেহান্তর ঘটলেও জ্যেষ্ঠভ্রাতার মতো শোক আর অশ্রুতে আপ্লুত হননি বালক জগদ্বন্ধু। মৃত্যু তাঁর কাছে ছিলো প্রাণের স্বাভাবিক এক পরিণতি মাত্র। আত্মা, প্রেতযোনি, অপদেবতা কোনোকিছুর ভয় কখনও স্পর্শ করেনি তাঁকে। বালক বয়সেই পাঠশালা পালিয়ে গ্রাম পার্শ্ববর্তী শ্মশানঘাটে একা একা চলে যাওয়া, সেখানে কদাচিৎ চলে আসা কোনো এক সাধু বা সন্ন্যাসী পুরুষের সাথে গভীর আগ্রহ নিয়ে নানা বাক্যালাপ করা অথবা তাদের গাঁজার কল্কেতে গোপনে টান মেরে দেওয়াতে তাঁর আগ্রহ ছিল বেশী। তাঁদের প্রভাব জগদ্বন্ধুর ওপর গভীর দাগ কেটেছিল। এই কারণেই সেই সব সাধু-সন্ন্যাসীর সাথে যাদের কোনো সম্বন্ধ নেই, তাদেরকে অর্থাৎ গুরুদেবের গ্রাম চণ্ডীতলার মানুষদেরকে সেইসব সাধুসন্তদের বহুউক্ত নানা বচন বলে অবাক করে দিতে শুরু করেছিলেন বালক জগদ্বন্ধু।
জগদ্বন্ধু বস্তুত একরকম আস্বাভাবিক বালক হিসেবেই ক্রমে পরিচিত হচ্ছিলেন। সকলের কাছে তিনি জগা পাগলা নামেই পরিচিত ছিলেন। সংসার জীবন যাপন করবার মতো কোনো বৈষয়িক বুদ্ধি, সামাজিকতা, পারিবারিক মানসিকতা তাঁর আদৌ ছিলো না। এমন এক বোহেমিয়ান চরিত্রকে পিতা অনাথবন্ধু বাধ্য হয়ে বিবাহের মাধ্যমে সমাজ-সংসারে বাঁধতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতো একজন পোর খাওয়া মানুষও পুত্র স্নেহের অন্ধত্বে অনুধাবন করতে পারলেন না যে, একটি নারীকে এমন একটি জীবন সাথীর সাথে যুক্ত করে দেবার অর্থ তার জীবনকে নষ্ট করে দেওয়া। জগদ্বন্ধু যে কোনোদিন তথাকথিত স্বামী হতে পারবে না, সন্তানের পিতৃত্ব পেতে পারবে না, এমন পূর্বাভাষ এক পীর কবিরাজ এই পরিবারকে দিয়েছিলেন। কিন্তু পিতা তো পিতাই। সকল পিতাই মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্র।
এদিকে পরিবারের চাপে হয়তো জগদ্বন্ধুকে কোনো সময় যজমান বাড়িতে পূজার্চনার জন্যে যেতে হতো। পুজোও তিনি করতেন পরম ভক্তিতে। কিন্তু পুজোর মন্ত্র দূরে থাকুক, কোনো প্রচলিত রীতিতে পুজো করতেন না তিনি। তাঁর দেবী আবাহন হতো সঙ্গীতে। নানা ভক্তিসঙ্গীত তাঁর সুলোলিত কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হয়ে সাধারণ মানুষকে মুগ্ধ করতো। প্রথম দিকে এমন পুজোতে অসন্তুষ্ট হতো গ্রামের মানুষ। গোস্বামী পরিবার বাধ্য হয়ে দুশ্চিন্তা করতে শুরু করে এই পাগল সন্তানকে নিয়ে। কিন্তু কালে কালে জগদ্বন্ধুর সেই ভক্তিসঙ্গীত পূজার্চনার এমন বাতাবরণ সৃষ্টি করতে শুরু করলো  যে, মানুষের কাছে সেই পুজোই হয়ে উঠলো একান্ত আপন। সুর আর সঙ্গীতের মহিমা আর একবার মানুষকে ভক্তিমার্গের নতুন পথ দেখালো। ফলে চণ্ডীতলার মতো এবং আরো নানা অজ গণ্ডগ্রামে জগদ্বন্ধুর এমন কর্মকাণ্ড মানুষকে এই কথা বিশ্বাস করতে অনেকটাই উদ্বুদ্ধ করেছিলো যে, তিনি নিশ্চয়ই এক সিদ্ধপুরুষ, মহাশূন্য থেকে খসে পড়া একজন স্বয়ং সাধক।
যখন প্রচলিত রীতি অনুযায়ী যজমানি জগদ্বন্ধুর দ্বারা সম্ভব হলো না, তখন তাঁর যে সাধন-ভজনের নিজস্বতা, তাঁকেই আশ্রয় করলো পরিবারের অন্যান্য মানুষ। যুবক জগদ্বন্ধু হয়ে উঠলো সাধক জগদ্বন্ধু। ভট্টাচার্য পদবী হওয়া সত্বেও যেহেতু আগাগোড়া পূজার্চনার পাশাপাশি দীক্ষাদান গুরু জগদ্বন্ধুর পরিবারের অন্যতম জীবিকা ছিল, সেহ্বেতু গোস্বামী পদবিটি যুক্ত হয়েছিলো অনেকদিন আগে থেকেই। এই সূত্র থেকে পাগলা জগাকে সাধক জগদ্বন্ধু পরিচয় লাভ করতে কোনো অতিরিক্ত ভূমিকার প্রয়োজন হয়নি। পূজার্চনা প্রচলিত রীতি অনুযায়ী জগদ্বন্ধু অবলম্বন করতে না পারলেও এই দীক্ষাদান বিষয়টি অত্যন্ত সহজেই তাঁকে খ্যাতনামা করে তোলে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। এই বিষয়টিকেও জীবিকা করে নেবার যতটুকু মতি থাকা দরকার, তা জগদ্বন্ধুর থাকুক, বা না থাকুক, তাঁর পরিবারের ও গ্রামের অশিক্ষিত মানুষেরা তাঁকে সম্পূর্ণ ব্যবহার করতে শুরু করে। মানুষের জীবনে পাপ, অধর্ম, অপকর্ম যত বৃদ্ধি পায়, ততই তাদের মুক্তির আর ভক্তির প্রয়োজন বেড়ে যেতে থাকে। তাই তো জগতে সামাজিক অথবা পারিবারিক দায়িত্ব-কর্তব্য পালন হোক, বা না হোক, মানুষের মধ্যে ঈশ্বরপুজা, গুরুভক্তি ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ফলে ধীরে ধীরে দীক্ষাগুরু জগদ্বন্ধুর আশ্রম, শিশ্যনিবাস, আরাধনা কক্ষ, প্রতিমা প্রতিষ্ঠা, প্রার্থনাকক্ষ গড়ে উঠতে লাগলো। বস্তু আর অর্থ যোগাতে থাকলো ভূতে। সেই ভূত মানুষ ভূত, ভক্ত ভূত। মানুষই নিজের তাগিদে ও বিশ্বাসে গুরুগৃহ গঠনে দিতে লাগলো জমি, অর্থ বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান। গড়ে উঠতে লাগলো বহু ব্যয়ে আশ্রমগৃহ। যে জগা পাগলা সংসারের দৃষ্টিতে একেবারে ফেলনা হিসেবে গণ্য হতো, সে-ই গোস্বামী পরিবারের শুধু নয়, হয়ে উঠলো সাতগাঁয়ের গর্ব। গুরু জগদ্বন্ধুর নামে মানুষ এক কথায় মাথা নত করে। তাঁর নামেই পিতা অনাথবন্ধুর নতুন পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হলো। প্রথমে গ্রামের সাধারণ মানুষ, পরে ধীরে ধীরে গণ্যমান্য, শিক্ষিত, সংস্কতিবান এবং এমনকি রাজনীতির তাবড় ব্যক্তিত্ব পর্যন্ত এই চণ্ডীতলার গুরুগৃহে শ্রেণী-ধর্ম-উচ্চ-নীচ নির্বিশেষে সকলের সাথে নিতান্ত লঙ্গরখানার মতো এক পংক্তিতে বসে দ্বিপ্রাহরিক আহার গ্রহণ করে। এই অবস্থা থেকে রচিত হতে শুরু হলো গুরুমাহাত্ম্য কাহিনী। সত্যের সাথে কল্পনা, অতি কল্পনার জল মিশ্রিত করে সেই মাহাত্ম্য কাহিনী গুরুকে করে তুলল ভগবান। এই সবই যে শুধুমাত্র ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে ঘটলো, তা নয়। নিতান্ত কুসংস্কার, অজ্ঞানতা আর মানসিক দৌর্বল্য মানুষকে বলতে বাধ্য করলো, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। অর্থাৎ অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব নিয়ে যুক্তি-তর্ক অনুসন্ধান কোরো না। বিশ্বাস করো। তবেই তুমি ভগবানকে পাবে।                                
তরুণ জগদ্বন্ধুর পিতা অনাথবন্ধু গোস্বামী জীবিত থাকতে পাঁচজনের পরামর্শে পুত্রকে নিয়ে একবার নদীয়ায় দরিয়ার গ্রামে সর্বজনবিদিত এক পীর কবিরাজের কাছে জগার মানসিক বিকারের চিকিৎসার জন্যে যাওয়া হয়েছিল। ব্রাহ্মণ পরিবারকে ধর্মীয় অভিমান থেকে বের হতে হয়েছিলো পুত্রের কল্যাণে। কিন্তু সেই পীর কবিরাজ কোনো ইতিবাচক আশ্বাস দেননি। তিনি সরাসরি জানিয়েছেন যে, উচ্চ বায়ু-কফ-পিত্তের কারণে জগদ্বন্ধুর মস্তিষ্ক বিকৃত কাজ করছে। এর চিকিৎসার কোনো উপায় নেই। অনাথবন্ধু এমন সঙ্কট থেকে মুক্তি লাভের যে কোনো একটি পথ অনুসন্ধান করতে গিয়ে অবশেষে পুত্রের বিবাহ দানের সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন। এই অন্ধ সমাজে এমন বিশ্বাস আজো প্রচলিত আছে যে, একটি নারীসঙ্গই পারে এক পুরুষকে তার আপন সংসার, সত্তা, দায়িত্ব আর কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে। ফলে চণ্ডীতলা থেকে তিন গ্রাম পেরিয়ে সাধনপুরের ব্রাহ্মণ পরিবার তিনকড়ি চক্রবর্তী মহাশয়ের কনিষ্ঠা কন্যা অন্নপূর্ণার সাথে বিবাহ সমাধা করবার প্রস্তাব গেল সাধনপুরে। তিনকড়ি চক্রবর্তী অনাথবন্ধু গোস্বামীর পরিবারে তাঁর কনিষ্ঠা কন্যার বিবাহ প্রস্তাব পেয়ে আপ্লুত। তখন জগা পাগলা সাত গাঁয়ে সাধক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। এমন সাধক হবে স্বয়ং জামাতা--- এই প্রস্তাব কে-ই বা  প্রত্যাখ্যান করতে পারে! ফলে বিবাহ হয়ে গেল জগা পাগলার। জগাকে বোঝানো হলো যে, সাধন-ভজনে মার্গে জীবনসঙ্গিনী হলো প্রকৃষ্ট পথ। ঘরে লক্ষ্মী এলো। অন্নপূর্ণা সুন্দরী নয়, কিন্তু শিক্ষাদীক্ষাহীনা দশ বছরের একটি সদ্য বালিকা হয়ে ওঠা মেয়ে তার পরিবারের অগ্রবর্তী নারীদের জীবন এবং দাম্পত্য লক্ষ্য করে যেটুকু প্রশিক্ষণ লাভ করেছে, তাতে এক বিপুল দাম্পত্য সুখের আশায় এসে হাজীর হলো জগদ্বন্ধুর স্ত্রী হয়ে। গভীর রাতে গৃহের সকলে নিদ্রা গেলে স্বামী জগদ্বন্ধু স্ত্রীর মুখটিকে নিজের দুহাতে ধরে বোঝালেন,
--- দ্যাখো অন্নপূর্ণা, তোমাকে শুধু নামেই অন্নপূর্ণা হলে চলবে না। এই যে আমাকে দেখছো, আমাকে অনেক মানুষ কিন্তু গুরুজ্ঞানে মান্য করে। এরা সকলেই অবুঝ। এরা আমার মধ্যেই ঈশ্বর প্রত্যক্ষ করে। কিন্তু সর্বকল্যানীয়া জগজ্জনীর মহিমা কিন্তু এরা জানে না। তোমাকে হতে হবে সেই সর্বকল্যানীয়া জগন্মাতা। একেবারে মায়ের মতো এদেরকে দেখতে হবে।
এমন শুনে বালিকা অন্নপূর্ণার শরীর রোমাঞ্চিত হলো। যন্ত্রবৎ অন্নপূর্ণা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। এবার বিস্মিতা বাক্যহীনা স্ত্রীকে জগদ্বন্ধু নিজে হাতে জড়িয়ে ডেকে নিলেন মাতৃমূর্তির সামনে। বললেন,
--- এসো, মায়ের সামনে বসো। তোমাকে দীক্ষা দিই।
অবুঝ অন্নপূর্ণা এক নববধূর মতো এসে বসল স্বামীর পাশটিতে। বেশ অনুভব করলো যে, তাঁর স্বামীর মধ্যে বিবাহ দিবসোত্তর স্বামীসুলভ তেমন কোনো পরিচিত অভিপ্রায় নেই। নারীজন্মের এই মহালগ্নে তাঁর গ্রামের অন্য অন্য সইদের যে বিবাহ হয়েছে, তাদের কাছে তাদের বিবাহিত জীবনের যে অভিজ্ঞতা সে শুনেছে, তাতে তো তার লজ্জায় রক্তবর্ণ হয়ে যাবার কথা। আজ তার সেই অনন্য অভিজ্ঞতার দিন। তাই ভয়, সংশয় আর দ্বিধায় আচ্ছন্ন ছিলো অন্নপূর্ণা। কিন্তু এতো তার এক অন্য অভিজ্ঞতা! জগদ্বন্ধু স্ত্রীকে স্পর্শ পর্যন্ত করলেন না। বরং স্ত্রীকে দেবীমূর্তির সামনে স্থাপন করে শপথ করালেন।
--- শপথ করো। বলো, আমি আজ থেকে এই মাতৃমন্দিরের ভক্তদের মা হয়ে এদেরকে রক্ষা করবো। এরাই আমার সন্তান।
স্বামীর দিকে পরম ভক্তিতে আর শ্রদ্ধায় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্ষুদ্র বালিকা মৃদুস্বরে অর্ধ আন্দোলিত অধরোষ্ঠে অলিখিত শপথ পাঠ করল--- আমি আজ থেকে এই মাতৃমন্দিরের ভক্তদের মা হয়ে এদেরকে রক্ষা করবো। এরাই আমার সন্তান।
এসব কথার মর্মার্থ ক্ষুদ্র বালিকা সেদিন বোঝেনি। কিন্তু সে স্পষ্ট অনুধাবন করলো না, সে কী করে একজন বালিকা হয়ে রক্ষা করবে নানা বয়সের এইসব মানুষদেরকে। কোন বিপদ থেকেই বা রক্ষা করবে! শুধু নব্য স্বামীর আচার আচরণে সে আরো বিস্মিতা ও কুণ্ঠিতা হলো যখন জগদ্বন্ধু নিজে শপথ বাক্য পাঠ করিয়ে তাঁর স্ত্রীর পায়ের কাছে মাথা নত করে তাঁকে নমস্কার জানালেন। অন্নপূর্ণা একেবারে রে রে করে উঠলো। এ কী আচরণ! এমন তো সে আগে শোনেওনি, দ্যাখেওনি। স্বামী তো গুরুর গুরু। তিনিই তো প্রনম্য, নমস্য। অথচ তিনি নিজে নিজের স্ত্রীকে প্রনাম করছেন! স্ত্রীকে জগদ্বন্ধু বোঝালেন,
--- দ্যাখো অন্নপূর্ণা, যে পুরুষ নারীকে প্রনাম করতে জানে না, সে কোনোদিন দেবীপূজার যোগ্য হয় না। নারী তো দেবীরই অঙ্গ। তুমি আজ থেকে এই দেবীমূর্তির সেবাইত দাসী। তুমিও আমারই মত সকলের প্রনম্য। আর তোমায় সেই স্বীকৃতি তো প্রথম আমাকেই দিতে হবে। তা নয়তো আমার শিশ্য, বা ভক্তেরা কেমন করে তোমাকে প্রনাম জানাবে! তুমিই তো মা। তোমার মধ্যেই তো মায়ের অবস্থান।
 বলেই জগদ্বন্ধু ঊর্ধ্বস্বরে জয় মা! জয় মা! স্বরে জয়ধ্বনি করে উঠলেন। আবার রোমাঞ্চিত হল অন্নপূর্ণার শরীর। বিবাহিত জীবনের প্রথম দিকটা অবুঝ বালিকা অন্নপূর্ণার বেশ আনন্দেই কাটল, কারণ এমন স্বল্প বয়সে তাঁর স্বামীর কাছে আসা নানা মানুষ যখন তাঁকেও মাতৃজ্ঞানে প্রনাম করছিলো, তখন উচ্চতার এক অভিমান তাঁকে এক অনাবিল আনন্দ দিয়েছিলো। এ ছিলো তার এক অনন্য অনুভূতি। নিজেকে মাতৃমূর্তি হিসেবে নিজেই প্রতিষ্ঠা করে তিনি নিজেই নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করলেন। প্রথমে রক্তপাত হলো অজ্ঞ মানুষের দৃষ্টি-বহির্ভূত নানা স্থানে। কিন্তু দিন মানুষের জীবনে একইভাবে কাটে না। মানুষ চিরকাল একই অবস্থানে নিজেকে আবিষ্কার করতে চায় না। তাই সে মানুষ। অন্যেতর প্রাণীর জীবনে মন-মানসিকতার কোনো পরিশ্রম নেই। তাদের যা কিছু, তা কেবলই শরীরে। কিন্তু মানুষ তার পরিবেশ পরিস্থিতি পরিবর্তিত করে বাঁচতে জানে। সমস্ত পরিকল্পিত কাজ সমাধা হলে অপরিকল্পিত কাজে সে ডুবে যায়। হিসেব মেলাতে বসে, কী পেলো, আর কী পেলো না। তাই তার দেহের বা মনের কোনো বিরামও নেই, আরামও নেই। এমনি অবশেষে একদিন মা কল্যাণেশ্বরী হিসেব মেলাতে বসে নিজের জীবনের। একদিন সে মর্মে মর্মে অনুধাবন করে যে, সে এক সম্পূর্ণ নারীতে রূপান্তরিতা হয়েছে। এমনটি জানামাত্র বিশ্বমাতৃত্ব থেকে এক ব্যক্তিনারীত্ব তাকে অনেক বেশী করে আন্দোলিত করতে শুরু করে। সে অনুধাবন করতে পারে, যে জীবন সে বরণ করেছে, তা প্রতিদিন তার বুকের মধ্যে রক্তপাত ঘটাবে। সেই সময় থেকেই মন্দিরে পুজো সমাপ্ত হলে ভক্তদের জয় মা! জয় মা! কলরোলে আতঙ্কিতা অন্নপূর্ণা দ্বাররুদ্ধ কক্ষের মধ্যে বসে দুই হাতে দুই কান চেপে মনে মনে রক্ষা করো মা!লে মিনতি করেছে। এমন মাতৃত্বের অহংকারকে দমিত করে বারংবার নারীত্ব যেন এক পরিপক্ক স্ফোটকের মতো এক দুর্দমনীয় বেদনায় বেদনার্ত করতে থাকে মা কল্যানেশ্বেরীকে। কিন্তু যে পথ সে সাগ্রহে সাফ করে নিজের জীবনের এক অনন্য পথ করে তুলতে প্রশ্রয় দিয়েছে, তা থেকে মুক্তি তো সহজ কথা নয়। বীরত্ব প্রকাশ করে বাঘের পিঠে চেপে বসা হয়তো যায়, কিন্তু সেই পিঠ থেকে নেমে দাঁড়ানোর কোনো উপায় এক সময় থাকে না। মুকুট তো পরাই যায়, কিন্তু তা মাথা থেকে অপসারিত করে ফেলতে পারে কজন!
এই বিষয় নিয়ে স্বামী জগদ্বন্ধুর সাথে নিশ্চিন্তে কথা মা কল্যাণেশ্বরী কথা বলতে পারতেন। বলার ইচ্ছেও তাঁর ছিলো। বাড়ির মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক কিম্বা আধ্ম্যাত্মিক যে কোনো মার্গে যত বড়ো ব্যক্তিত্বই হন না কেন, গৃহে তিনি তো কারোর পিতা, কারোর স্বামী, কারোর পুত্র। তাদের কাছে তিনি তো যে ব্যক্তি, সেই তিনিই থাকেন। তাঁর কাছে একেবারে অন্তরঙ্গ কথা তো বলাই যায়। তেমনই তো গুরু জগদ্বন্ধু। কিন্তু মা কল্যাণেশ্বরী তাঁর স্বামী পাগল হোক, আর যাই হোক, তাঁকে অত্যন্ত ভয় করতেন। তিনি ভালো করে বুঝতেন, তার সাথে তার স্বামীর মানসিক পার্থক্য আকাশ পাতাল। তার স্বামী স্বয়ং গুরুদেব, কিন্তু তিনি নিজে মা হয়েছেন বৈবাহিক সূত্রে। জগদ্বন্ধুর স্ত্রী হবার কোনো যথার্থ যোগ্যতাও তার নেই, তিনি এমন কিছু করেননি ভক্তদের জন্যে যার জন্যে তারা তাঁকে মা সম্ভাষণ করতে পারে। তিনি যথার্থ সাধিকাও নন। তাকে সাধিকা বানানো হয়েছে। তিনি বানানো মা। তাই একদিন খুবই সঙ্কোচের সাথে মা তাঁর স্বামীকে একান্তে মা জানান,
--- প্রভু, আমাদের আধ্যাত্মিক জীবন যত বড়োই হোক না কেন, আমরা তো গৃহী বটেই। মানুষের সংসার ছেড়ে তো আমরা পাহাড়ে বসবাস করছি না।
গুরু জগদ্বন্ধু হেসে স্ত্রীকে জানান--- আমাকে কিছু বলতে তুমি এ্যাতো ভূমিকা কেন করছো! যা বলতে চাও, স্পষ্ট করে বলো।
--- আমাদের বিবাহের সাত বছর পার হয়ে গেলো, আমাদের নিজেদের কোনো সন্তান নেই। আমারও তো মা হতে সাধ জাগে। আমাদের আশ্রমে নানা ভক্ত আসে, তাদের মধ্যে অনেক সন্তানের মা-ও থাকে। তাদের দেখে আমার নিজের মা হতে বড়ো সাধ হয়। আমি মা কল্যাণেশ্বরী আছি, সে তো ভালো কথা। আমার কি নিজের সন্তান থাকতে নেই।
অন্নপূর্ণার কথা শুনে আবার হেসে দেন জগদ্বন্ধু ঠাকুর। স্ত্রীকে বুঝিয়ে বলেন--- অন্নপূর্ণা, মানুষ সংসার জীবন যাপন করতে করতে সমাজের কাজ, মানুষের কাজ, দেশের কাজ করতে পারে। শুধু পারে নয়। সেটাই সাধনার সঠিক পথ। কিন্তু সকলেই যদি সংসার জালে জড়িয়ে থাকে, তবে মার্গ দর্শন করাবে কে? কাউকে তো এগিয়ে এসে দায়িত্ব নিতে হবে। মা জগজ্জননী এ দায় আমার কাঁধে অর্পণ করে গেছেন। আমি তো তোমাকে পেয়েছি এই সাধন পথে এগিয়ে যেতে।
--- কিন্তু আমি যদি মা-ই হতে না পারি, তবে মাতৃস্নেহ অপরকে দেবো কেমন করে?
--- তুমি হাসালে আমাকে, অন্নপূর্ণা। জগতের সমস্ত বস্তুর বা ভাবের অনুধাবন কি তার রং-রূপ-গন্ধ-বর্ণের আস্বাদ গ্রহণ করে করতে হয়! মানুষ তো তার জ্ঞানের মাধ্যমে, চেতনার মাধ্যমেই তা অনুধাবন করে। তুমি নারী হয়ে জন্মেছো। এ যে বড়ো পুণ্যি গো। নারী তো জন্মমাত্রই মা হয়ে যায়। তাকে শুধু গর্ভধারণ করেই মা হতে হয় না, গো। এ নিয়ে দুঃখ করো না। এই যে তুমি এই আশ্রমের সকলের মা, আশ্রমের বাইরেও তোমাকে যে মানুষ মা বলে মানে, এ তোমার কত বড়ো ভাগ্যি! সেটা মানো। তুমি গর্ভধারণ করলে যে আর সকলের মা হয়ে উঠতে পারবে না। দ্যাখো, যে মাছ একবার নদীতে ভেসেছে, সে কি আর এঁদো ডোবাতে কাদাঘোলা জলে এসে সাঁতার কাটতে চায়! তুমি কেন তা চাইছো?
কথায় অন্নপূর্ণা পারেননি তার স্বামীর সাথে। তিনি বুঝেছেন যে, তার স্বামী হয়তো তথাকথিত লেখাপড়া জানেন না, কিন্তু তাঁর জ্ঞানের ভাণ্ডারে এমন কিছু আছে, যা তথাকথিত সাধারণ বা অসাধারণ মানুষের নেই। তাই তারা তার স্বামীর পায়ের কাছে বসে থাকে, তাঁর আরাধনা করে, তাঁকে প্রভু বলে মানে। তিনি এমনি এমনি গুরু পরমপুরুষ জগদ্বন্ধু ঠাকুর হিসেবে গোটা দেশে বন্দিত নন। ইহলোক পরলোক জন্ম-জন্মান্তর জ্ঞান ভক্তি ইত্যাদি সম্বন্ধে উচ্চ নীচ শিক্ষিত অশিক্ষিত খ্যাত অখ্যাত সমস্ত মানুষকে পথের দিশা প্রদর্শন করেন। মানুষ তাঁর বানী শুনবার জন্যে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে। আর মা কল্যানেশ্বরী হলেও অন্নপূর্ণা নিজে তো নিরক্ষর মাত্র। স্বামীর দেওয়া কথার যুক্তির সাথে তিনি কীভাবে এঁটে উঠবেন! স্ত্রী বলেই তিনি ভালোমতো জানেন যে, তাঁর স্বামী তাঁকে সন্তান দিতে পারুন, না পারুন, তিনি মানুষটা ভালো। বিষয়-আশয়, ধন-দৌলত, আশ্রমের এই প্রতুল সম্পত্তি, শিশ্যদের এ্যাতো হাজার হাজার টাকার অনুদান--- এসব কিছুই তিনি বোঝেন না, বুঝতে চান না। তিনি তাঁর সাধন-ভজন নিয়ে মগ্ন। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা তিনি না বুঝলেও আজ পর্যন্ত স্ত্রীকে তিনি কোনো কারণে তিরস্কার করেননি, মন্দ বলেননি তো বটেই, কেমন যেন একটা মাতৃজ্ঞানে সমীহ করে চলেন! বিয়ের দশটা বছর পার হয়ে গেলেও একদিনের জন্যে স্ত্রীকে স্পর্শটুকু করেননি। অথচ সংসারধর্ম সম্বন্ধে কী অসাধারণ জ্ঞান মানুষটার। যখন আসরে বসে শিশ্যদের পাঠ শোনান, তখন যেন মনে হয়, হাতে কলমে নিজের প্রাপ্ত শিক্ষা তাদেরকে বিতরণ করছেন। তাতে শিশ্যদের কতটুকু উপকার হয়, তার খবর মা হিসেবে তিনি না রাখলেও দিনে দিনে যে তাঁর স্বামীর শিশ্যসংখ্যা বেড়েই চলেছে, তাতে সন্দেহ কী! মানুষ এখানে এসে শান্তি পেতে চায়। মাঝে মাঝে মা কল্যানেশ্বরীর এ কথাও মনে হয়, যদি মানুষ সত্যি এমন এক শান্তির সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়, তবে দেশ জুড়ে এমন হিংসা, অশান্তি, রক্তপাত, ঈর্ষা বেড়ে চলেছে কেন? এরাই তো সেই সব মানুষ যারা এখানে এসে পূজার্চনা করে, গুরুদেবের পাঠ শোনে, তাদের উপার্জিত ধন-অর্থ মুঠো মুঠো দান করে যায় এই আশ্রমে, আর তাই দিয়েই তো নর-নারায়ণ সেবা হয় প্রতিদিন। তাহলে কেন এই বৈপরীত্য? কেন এই স্ববিরোধ? কেন এই আত্মসংঘাত? কোথায় একটা ফাঁক ঘটছে।
কিন্তু ফাঁকটা যে কোথায়, তা তো তাঁর মতো একজন নিরক্ষর অজ্ঞান নারীর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তার চেয়ে বড়ো কথা, এই মানুষটাকে তিনি নিজে স্বামী হিসেবে ভালবাসতে পারুন, না পারুন, কাছে পান, বা না পান, এই মানুষটাকে তিনি কোনোভাবেই ছেড়ে চলে যেতে পারবেন না। এই মানুষটা যে নিষ্পাপ, নির্দোষ আর নির্ভেজাল, এ বিষয়ে কোনো সংশয় ছিল না মা কল্যানেশ্বরীর। এমন এক মানুষকে মাঝে মাঝে কেমন একটা ভয়ও লাগে তাঁর। মানুষটাকে নানাভাবে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করতে সাধও তাঁর হয়েছে। কিন্তু সাহস হয়নি। মানুষটার সামনে এলে কেন জানি ঠোঁট জড়িয়ে আসে, বাক্য দুর্বল হয়, মনে করে রাখা কথাও হারিয়ে যায় স্মৃতি থেকে। এমন একটা অদ্ভুত মানুষের হাতেই তো সমর্পণ করে তাঁর বাবা দেহত্যাগ করেছেন। মেয়েকে এমন একটা মানুষের হাতে সঁপে দিয়ে তিনি নিজের সন্তানের কী ক্ষতি করেছেন, তা তিনি জানতে পারেননি। জানতে পারেননি বলেই মৃত্যুকালে এক পরম প্রশান্তি ছিল তাঁর চোখমুখে। পিতার আত্মাকে কোনোভাবে সন্তান হিসেবে তিনি বেদনা দিতে চাননি। আবার মাঝে মাঝে এমন বিশ্বমাতৃত্ব তাঁকে এমন এক যন্ত্রণায় ঠেলে দিচ্ছিল যে, সমস্তকিছু ফেলে একদিন সকলকে না জানিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছেন তিনি। কিন্তু পারেননি। আষ্টেপৃষ্ঠে ললাটে জড়িয়ে গিয়েছেন এই আশ্রমের সাথে, এই বিশ্ব মাতৃআসনের সাথে, মন না চাইলেও বাইরের থেকে জোর করে ভক্তদের প্রতি মাতৃবানী শোনানোর সাথে। যে আগুন তিনি একদিন গলাধঃকরন করেছেন, তার দহন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি তো নেই।
কিন্তু আজ? আজ তো তাঁর সমস্ত বন্ধন ছিঁড়ে গেছে, সব প্রতিশ্রুতির আজ অবসান। সত্তর বছর আগেকার যদিদং হৃদয়ং তব, তদস্তু হৃদয়ং মম... আজ কোন অন্তরীক্ষে উধাও! আজ যখন তাঁর স্বামী গুরু জগদ্বন্ধুর মরদেহ সমাহিত করা হয়েছে, তখন আঁতকে উঠেছেন মা কল্যাণেশ্বরী। একজন হিন্দু ব্রাহ্মণের দেহ যে দাহ করতে হয়, অন্যথায় তাঁর আত্মার প্রতি অমর্যাদা করা হয়, সেই সত্যকে কোনো মূল্য না দিয়ে এক অলিখিত প্রথা অনুযায়ী আশ্রমের মন্দির পার্শ্বস্থ জমি খনন করে তাঁর স্বামীর পুণ্যদেহ প্রথিত করা হয়েছে। এটাই মেনে নিতে পারেননি মা কল্যানেশ্বরী। যেইমাত্র তিনি এমনটা অনুধাবন করেছেন যে, তাঁর দেহান্ত ঘটলে তাঁকেও কবরস্থ করা হবে, তৎক্ষণাৎ এই আশ্রম থেকে, এই সাধন-ভজন থেকে, এই শিশ্যদের পরিমণ্ডল থেকে দূরে, অনেক দূরে চলে যেতে ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন মা কল্যাণেশ্বরী। কিন্তু কেউ তাঁর ব্যাকুলতা শোনেনি। সকলেই নিজের মতো করে ভেবেছে। তাঁকে একরকম বাধ্য করেছে আশ্রমে অবস্থান করতে। তাই আদালতের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় তাঁর হাতে ছিলো না। আশ্রমে আসা কয়েকটি তরুণকে আশ্রয় করে আজ এসেছেন আদালতে। ঐ ফুটফুটে ছেলেগুলো এক নিঃসঙ্গ অবস্থায় মায়ের মনের কথা শুনে বিশ্বাস করেছে। ওরা স্থির করেছে, কোনো এক বৃদ্ধাবাসে মা কল্যানেশ্বরীকে স্থান করে দেবে। অপরিণত ঐ ছেলেগুলোর কোনো জ্ঞান নেই, বুদ্ধি নেই, স্বার্থ নেই, সংশয় নেই। ওরা মায়ের অশ্রু দেখেছে, মায়ের দুঃখ বুঝেছে। কল্যাণেশ্বরী মায়ের আজ মনে হয়, এই আশ্রমের এ্যাতোগুলো মানুষ কেউই তাঁর কথার গুরুত্ব দেয়নি। প্রকৃতির কী অদ্ভূত খেলা যে, এই অবুঝ তারুণ বয়স্ক ছেলেগুলোর মধ্যে অত্যাশ্চর্যভাবে মায়ের পাশে দাঁড়াবার এক ইচ্ছের জন্ম দিয়েছে। এরা তো ভক্তি বোঝে না, সাধন বোঝে না, ভজন জানে না, মুক্তির খবর রাখে না। কিন্তু এমন একটা সার কথা কীভাবে বুঝলো!
আদালত মায়ের বয়ান শুনে সম্পূর্ণ পরিতুষ্ট হতে না পেরে অবশেষে গুরু জগদ্বন্ধু ঠাকুরের প্রধান শিশ্য গুরু দিগদর্শনানন্দজীকে আদালতের কাঠগড়ায় সাক্ষ্যের জন্যে আহ্বান করা হয়। তিনি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মায়ের উদ্দেশে সাষ্টাঙ্গে প্রনাম জানিয়ে অবশেষে আদালতকে উদ্দেশ করে জানান,
--- মহামান্য আদালত, আজ আদালতে জগজ্জনী মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি বড়োই বেদনার্ত। কিন্তু মা জগন্মাতা তো সাক্ষাত মা। শুধু আমাদের জন্যেই নয়, ঠাকুরের প্রতি ওঁর অগাধ যত্ন ছিল। তাঁকে হারিয়ে মা আজ বস্তুত দিশেহারা। এটাই স্বাভাবিক। আজ সাতটি দশক মা ঠাকুরের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছেন। ঠাকুরের এই মহাপ্রয়াণ মাকে আহত করেছে। মায়ের বিশ্রাম চাই। এ তাঁর মানসিক অস্থিরতা ব্যতীত অন্য কিছু নয়।
চুপ করে বিচারক শুনতে থাকেন গুরু দিগদর্শনানন্দজীর সাক্ষ্য। আজ দীর্ঘ কুড়ি বছরের এই জীবিকায় তিনি এই প্রথম এক বিপুল দ্বিধা, আর অসীম দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গেছেন। কোন সিদ্ধান্তে তিনি আজ উপনীত হবেন, আজ তা স্থির করতে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। কার পক্ষ নেবেন তিনি। মা কল্যাণেশ্বরী উন্মাদ নন, অপরিণত বয়স্কা নন। কীভাবে তিনি তাঁর এই জবানবন্দী অস্বীকার করবেন! অথচ গুরু দিগদর্শনানন্দজীর বয়ানও তো ফেলে দেবার নয়। কিন্তু তাঁকে একটি সিদ্ধান্তে তো আসতেই হবে। বিশেষত তিনি নিজে ঠাকুর জগদ্বন্ধুর ভক্ত। অগত্যা আদালত সেদিনকার মতো মুলতুবী করে একটি অন্য তারিখ দিতে হবে, এমন সিদ্ধান্তেই তিনি উপনীত হলেন। আজই কোনো সিদ্ধান্ত জানানো চলবে না। বাইরে একটু অন্য স্তরে আলোচনা করতে হবে। এ অত্যন্ত জটিল সিদ্ধান্ত। এক কলমের খোঁচায় সর্বনাশ হতে পারে।
আজও মা কল্যাণেশ্বরী নদীয়ার গুরু জগদ্বন্ধুর পরমপুরুষের আশ্রমের একটি কক্ষে দিন গুনছেন। আগামী ছ-মাসের অপেক্ষায় তাঁকে থাকতে হবে। ছ-মাস পরে মায়ের মানসিক অবস্থা অনুযায়ী আদালত সিদ্ধান্ত নেবে। সেদিনকার মতো আদালত মুলতুবী করে পনেরো দিন পরে যে তারিখ দেওয়া হয়েছিলো, সেদিন আদালতকে জানাতেই হয়েছে,
--- আদালত মা কল্যাণেশ্বরীর বয়ান যথেষ্ট বিবেচনার সাথে বিচার করেছে। পাশাপাশি গুরু দিগদর্শনানন্দজীর সাক্ষ্যও চিকিৎসা বিজ্ঞানসম্মত বলে আদালত মনে করছে। তাই মা কল্যাণেশ্বরীকে আগামী ছটি মাস পর্যবেক্ষণে রাখা হবে আশ্রমের একটি কক্ষে। তাঁর জীবন যেমনটি চলছিলো, তেমনটিই চলবে। অর্থাৎ তিনি যথারীতি ভক্ত সন্তানদেরকে সাক্ষাত দিতে পারবেন, আশ্রমের যে কোনো অনুষ্ঠানে তাঁর আসন পূর্ববৎ থাকবে। ছ-মাস পরে যদি মা তাঁর সিদ্ধান্তে অবিচল থাকেন, তবে তাঁকে তাঁর মতো স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে আদালত করার দেবে।
সাথে আদালতের মধ্যে আর বাইরে হাজার হাজার ভকদের মধ্যে আনন্দের কলরোল পড়ে যায়। আইনের সাথে যুদ্ধে জয় হলো ভক্তির।

-------------------------


বৃহস্পতিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১২

'মমতা' ছোটগল্প



মমতা
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়

আমার এনজিও-টির নাম Street Illiterate Salutary Organization। সকলে ছোট করে বলতো শিশো। এই শিশো শব্দটি কালের কবলে হারিয়ে আজ হয়েছে শিশু। অবশ্য আমার কাজ শিশুদেরকে নিয়েই। আমার এই শিশোর কাজই হল, রাস্তার পাশে যে সব ঝুপড়ি, বস্তি ইত্যাদি আছে, তার শিশুদেরকে জীবনের মূল স্রোতে টেনে এনে একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের খোঁজ দেওয়া। আজ থেকে বারো বছর আগে যখন এই শিশো জন্ম নেয়, তখন শুধু এই স্ট্রিট চিলড্রেনদের শিক্ষা নিয়েই আমরা কাজ করতাম না। শুরুতে একটু বড়ো করে কাজ শুরু করতে হয়েছিলো ফিনান্সারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। শিশুসহ অন্যান্যদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে নানা কাজ করতাম। গ্রামেগঞ্জে নানা স্থানে বিনা অর্থব্যয়ে চক্ষু চিকিৎসা, রক্ত পরীক্ষা, থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা, এমন নানা কাজ করেছি। তখন আমার নিজের অল্প বয়সজনিত কারণে একটা আদর্শ থেকে নেমেছিলাম এই কাজে। যুবক বয়স থেকে এই কাজে নিমগ্ন থাকতে গিয়ে আমি জীবনে চাকরীর চেষ্টা পর্যন্ত করতে পারিনি। বাড়িতে, আত্মীয়মহলে, এমনকি প্রতিবেশী দরবারে নানা নিন্দামন্দ আমাকে শুনতে হয়েছে। আমাকে বাউন্দুলে হিসেবে অনেক বদনাম শুনতে হয়েছে। তখন এনজিও শব্দটি মানুষ তেমন শোনেনি। এনজিও পুরো কথাটাও জানা ছিলো না মানুষের। এটি খায়, না মাথায় মাখে--- তা জানতে চায়নি কেউ। তখন থেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে চলতে আজ শিশোকে একটা ভালমন্দ রূপ আমি দিতে পেরেছি। আজ গোটা উত্তর ২৪ পরগনা জুড়ে আমার এই সংগঠনের কাজ চলে। শিশুদের এমনকি তাদের পরিবারের বয়স্কদেরও স্বাক্ষরতা দেওয়া থেকে শুরু করে তাদের সচেতনতা তৈরী আমার এই শিশোর কাজ। কিন্তু আজ আর আমাকে বাউন্দুলে, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানে পার্টি ইত্যাদি ইত্যাদি শুনতে হয় না। বরং আজ আমি শুনি, আমি লেগেছিলাম বলেই এখানে আসতে পেরেছি। আজ আমার এটাই জীবন-জীবিকা। শুধু জীবিকা নয়, আজ প্রতিবেশী ও আত্মীয়মহলে আমি ঈর্ষার পাত্র। আমার নিজস্ব একটা গাড়ি, তিনতলা বাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ থেকে শুরু করে সব। সবকিছুতেই আমি আমার আত্মীয়মহলে সবচেয়ে এগিয়ে। সবই আমার এই শিশোর কল্যাণে। তাই আজ মানুষ আড়ালে বলে--- ধান্ধাবাজ। সমাজের কাজ করে, না হাতী করে।
কিন্তু আমি ওসব কথায় কান দেই না, কারণ আমার শিশোতে আজ কাজ করে জীবিকা অর্জন করছে অন্তত এগারোটি মেয়ে, তেইশ জন ছেলে। তাদেরকে আমি রীতিমত মাইনে দিই। অন্তত দু-হাজার শিশু আর তাদের পিতামাতা জড়িয়ে আছে এনজিও-টির সাথে। আমার স্ত্রী কিন্তু আমাকে এ বিষয়ে মোটে পোঁছে না। সে বলে,
--- ছাড়ো তো। ফুটপাথের শিশুদের আবার পড়াশুনো। পড়াশুনো কি সবার জন্যে! সবাই যদি সব করে, তবে তো মহা মুশকিল। এইজন্যেই বর্ণাশ্রম ছিল সমাজে। সব কাজ সকলকে দিয়ে কোনোদিন হয়নি, হয়ও না। প্রকৃতি সকলকে একই সামর্থ্য দিয়ে পাঠায়নি।
আমি মুখস্ত করা কথা বলি--- সে কি! এ তো অগণতান্ত্রিক আর কায়েমি স্বার্থের কথা বলছো তুমি। একটা সভ্য দেশে এমনটা চলে নাকি!
--- চলে চলে। জোর করে অন্য কিছু চালাতে গেলে অনর্থ হয়। দেখছো না? দেশে কী অনর্থ ঘটছে?
--- কী অনর্থ ঘটছে? আমি ভ্রু কুঁচকে বলি।
অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং গভীর আস্থার সাথে আমার স্ত্রীদেবী বলেন--- চাষির ছেলেপুলে দল বেঁধে চাষ ছেড়ে চাকরী করতে ছুটছে। একদিকে চাষের জমি নিষ্ফলা যাচ্ছে, আর একদিকে যাদের সেই জমিটুকু নেই, তাদের চাকরীতে থাবা বসাচ্ছে এইসব মানুষ। বেকার সমস্যা বাড়ছে। আরে বাবা, ধাঙ্গড় যদি বলে, নোংরা ধোব না, বাবু হবো, তবে তো তোমাকে-আমাকে সেই নোংরা ঘাঁটতে হবে। সেটা পারবে তো?
আগে ভেবে না দেখলেও তক্ষণই মেনে নিতে পারিনি স্ত্রীর এ হেন অকাট্য যুক্তি। তাই বিরোধ করি--- তাই বলে শিশুর জন্মগত অধিকার থাকবে না! সে পড়াশুনো করতে পারবে না! এটা কি বিচার? ওদের এই শৈশব কি প্লাস্টিক কারখানায়, দেশলাই কারখানায়, চায়ের দোকানে খাটতে খাটতে শেষ হবার জন্যে?
আমার স্ত্রী আক্রমণ করে--- এ্যাতো যে বলছো! বলতো, কারা ওরা? আমি বলছি, শোনো। ওরা বাংলাদেশ থেকে ঝেঁটিয়ে এখানে এসে ভিড় বাড়িয়েছে। দুমদাম বাড়িঘর, ফ্ল্যাট, দোকান কিনে নিচ্ছে, বাজার দর বাড়িয়ে ফেলছে, টাকার গরম দেখাচ্ছে। এ হলো পয়সাওয়ালা মানুষগুলো। ওরা আমাদের মুখের অন্ন তো ছিনিয়ে খাচ্ছেই, এবার ঐ রাস্তার মানুষগুলো আরো কী কি ছিনিয়ে নেবে, কে জানে। আর কারখানার কথা বলছো? ওদের বাপ-মা তো ওদেরকে কাজে পাঠিয়ে ওদের রোজগার খাবে বলেই ওদেরকে পৃথিবীতে এনেছে। যার বিয়ে তার হুঁশ নেই, পাড়া-পড়শির ঘুম নেই। বাপ-মা তাদের সন্তানকে ক্যাশ করছে, আর তুমি করবে দেশোদ্ধার। ওদের ল্যাঠা ওদেরকেই সামলাতেই দাও না কেন? তুমি কে? সরকার আর পার্টি তো তোমাকে-আমাকে নয়, ওদেরকে দেখার জন্যে এক পা তুলে বসে আছে। এ্যাতোগুলো এক্সট্রা ভোট। এর মধ্যে আবার তুমি কেন?
আমি কী করে স্ত্রীকে বোঝাই, হে বঙ্গললনা, তুমি যাহা কহিতেছো, তাহা যথার্থ বটে। কিন্তু এই যে তোমার এই ঠাট-বাট--- এই সকল  তো ওই শিশুগুলাকে মাধ্যম করিয়াই ঘটে। আমি যে মুঠা মুঠা অর্থ বরাদ্দ পাই, তাহা তো তোমার উদরস্থ করিবার জন্য নহে, রানী। এই এনজিও-টিকে ভরসা করিয়াই তো তোমার এই গৃহে আগমন, শপিং নামক একটি ব্যয়বহুল নেশা করা, ভ্রমণ, ফুর্তি।
কিন্তু সব কথা তো মুখ ফুটে বলতে হয় না। সব সত্যি জানার নয়, সব সত্যি বলার নয়, সব সত্যি বোঝাবারও নয়। আমিও মানি, আমার স্ত্রী যা বলছে, তা শতকরা একশ ভাগ সত্যি। আমি এইসব এনজিও-ফেনজিও করে দেশের কোনো বিপ্লব-টিপ্লব ঘটাবো না। শুধু রাজভোগ চাই আমার। এটা একটা মোক্ষম পথ। আমি জানি যে, আজকের দিনে এসব নিতান্ত ভালো কিছু ভাবা একটা বিলাসিতা মাত্র। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু এলোমেলো বিপরীত ভাবনাও আমার মাথায় চেপে বসে। আগে এমন ভাবনাটা মোটেই হতো না। কিন্তু আজকাল রাতে ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি, কে যেন বলছে, তুমি একটা হিপোক্রিট, নরকের কীট। প্রতারণা করে জীবন ধারণ করছো।
আজও এইসব ভাবছিলাম, এই সময় আমার প্রজেক্ট এগজিকিউটিভ সমর এসে প্রায় কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে জানালো--- স্যার, ভেরি সরি, একটা কথা আপনাকে জানানো হয়নি। অবশ্য এটা আমারই দোষ। আমি আমাদের এই লেটেস্ট এক্সটেনসিভ প্রজেক্টটা কভার করতে গিয়ে একটা সাইট মিস করে গেছি। অথচ কাজটা প্রায় শেষের পথে।
আমি কৌতূহলী--- কী ব্যাপার বলো তো? কোন সাইট?
--- আর এন বোস রোড, স্যার। ওখানে বেশ কিছু স্লাম টাইপ ঝোপর পট্টি আছে। অন্তত আড়াইশো ফ্যামিলি আছে আর এন বোস রোডের দুপাশের ফুটপাথে। পুরোটা বাদ পড়ে গ্যাছে।
আমার মাথায় হাত পড়ে গেলো শুনে। প্রজেক্টটা প্রায় সমাপ্তির পথে। এটা জমা দিতে পারলেই একটা ফ্যাট গ্র্যান্ট এসে যাবে। এটা আমার শীশোর কাজের সবচেয়ে বড়ো গ্র্যান্ট। আগামী সাত দিনের মধ্যে এর টোটাল ফিচার আমাকে দিতে হবে। এমনকি এর একটা সার্ভেও করা হবে টাকা স্যাংশান করার আগে। কিন্তু হাতে সময় কৈ? সমর আমার বিরাট টেবিলটার সামনে নিতান্ত অপরাধীর মতো মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তো বলতে পারছি না, দোষটা আমারও। প্রজেক্ট সীটটা চেক করার সময় আমিও মিস করেছি এই এরিয়া। আর এন বোস রোড আমার অচেনা নয়। আমার অফিস থেকে মাত্র পাঁচটা বাস স্টপেজের পরে। শুধু তাই নয়। বরং বললে ভালো হয়, এটা আমার বিলক্ষণ চেনা লোকালিটি। এর সাথে জড়িয়ে আছে একটা অবিস্মরণীয় স্মৃতি। মাত্র দুটো বছর আগের ঘটনা সেটা।
প্রত্যুষ। মানেন প্রত্যুষ মৈত্র আমার ক্লাসমেট। ওর বিয়েতেও আমি ছিলাম। শুধু ছিলাম না, ওর বাসরঘর থেকে শুরু করে ফুলশয্যা অবধি আমার আবাধ বিচরণ ছিল। সেই প্রত্যুষ ওর বিয়ের পরের বছরেই হঠাৎ একদিন আমার সাথে কনট্যাক্‌ট করে ও। একটা ভয়ঙ্কর প্রব্লেমে ফেঁসে গিয়ে আমার হেল্প চায়। আমি ওর বাড়ীতে গিয়ে একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম। যা ঘটেছে, তাতে না আছে ওর হাত, না আছে ওর মিসেস-এর হাত। একেবারে ঈশ্বরের মার। সত্যিই ওরা ফেঁসে গিয়েছে একটা ক্রাইসিসে। ওর মিসেস প্রেগন্যান্ট--- এটা আমি জানলাম। সেটা তো ক্রাইসিস নয়। কিন্তু এই প্রেগ্ন্যান্সির পরিণাম যে এমন ভয়াবহ হবে, তা তো কেউ ভাবেনি। ইউএসজি করে ডাক্তার বলেছে যে, বেবি এ্যাবনরম্যাল। পসিব্লি স্প্যাস্‌টিক পেশেন্ট হবে বেবি। প্রথম চাইল্ড স্প্যাসটিক হবে এটা মেনে নিতে পারে কোন প্যারেন্ট? প্রত্যুষও পারেনি। অথচ সিচুয়েশন তখন হাতের বাইরে। বেবি এ্যাতোটাই ম্যাচিওরড হয়ে গেছে যে, এ্যাবোর্‌ট অসম্ভব।
মাথা গরম করে প্রত্যুষ আমাকে বলে ওঠে--- দেব, আই কান্ট এ্যাফোর্‌ড দিস। এই চাইল্ড নিয়ে আমি কি সারা জীবন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলবো নাকি? এই আপদ নিয়ে আমি কী করবো!
আপদ কথাটা এমনভাবে বলল, যেন আমিই ওর স্ত্রীর প্রেগ্ন্যান্সির জন্যে বা এই বেবি এ্যাবনরম্যাল হবার জন্যে দায়ী। আমি অবস্থা সামাল দিতে গিয়ে বলি--- আহা, মেনে নিবি না, তো কী করবি? এতে তো কারোর হাত নেই রে। আর বেবিরই বা কী দোষ! শান্ত হ। সব ঠিক হয়ে  যাবে।
কথাকটা বললাম বটে, কিন্তু আমি নিজেও জানি, কিছুই ঠিক হবার নেই। এই বেবি যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন এর লোড ওদেরকে বইতে হবে। এটা অবশ্য মঙ্গল যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমন বেবি দীর্ঘকাল বাঁচে না।
প্রত্যুষ কী বুঝলো, জানি না। কিন্তু আমার কথা শুনে আর কোনো দ্বিতীয় মন্তব্য করলো না। শুধু আমাকে বলল,--- এ ফ্রেন্ড ইন নীড ইজ এ ফ্রেন্ড ইনডিড, দেব। আমাকে একটা হেল্প কর।
আমি টেড়িয়ে তাকিয়ে দেখলাম, ওর বৌ নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। এই অবস্থায় কী বলতে হয়, আমি জানি না। আমি তো বিয়েই করিনি তখন। শুধু মনে মনে জপ করছি, ঐ রকম একটা প্রভার্‌ব দিব্যি দিয়ে আমাকে যেন আবার বলে না বসে, তোর শীশোতে বাচ্চাটা বিয়ে নে। আমার তো সে রকম কোনো প্রভিশন নেই। তাই ক্যাবলার মতো বললাম--- কী হেল্প চাইছিস, বল।
--- তোর তো নানা ডাক্তার-বদ্যি নিয়ে কারবার। আমাকে একটা ভালো গায়নো দে। বেশ ভালো গায়নো। পুরুষ। মহিলা হবে না। আমি তার কাছেই ডেলিভারি করাবো।
আমি ভাবলাম, পুরুষ কেন? সকলে মহিলাই তো চায়। বললামও--- কেন? পুরুষ কেন?  
ও বলল--- এটা খুব ডেলিকেট কেস। ডাক্তার বলেছে। আমি কোনো লেডি ডকের ওপর ডিপেন্ড করতে পারছি না। 
আমি কথাটা শুনলাম, মনে মনে আনন্দিত হলাম, কেননা আমি যে আশঙ্কা করছিলাম, তেমন তো কিছু বলেনি। উপরন্তু আমার কথা শুনেছে। আর যেটা ও চাইছে, সেটা তো আমার পক্ষে জলভাত। ঐ আর এন বোস রোডের যে নার্সিংহোম আছে, সেটা এতদঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো আর অভিজাত নার্সিংহোম। এর সাথেই যুক্ত আমার বিশেষ খাতিরের ডক্টর বুধাদিত্য রায়। একডাকে চেনে সকলে। তাই প্রত্যুষের স্ত্রীকে ভর্তি করা হল লাইফ টাইম নার্সিংহোমে। কিন্তু কেন যে ও আমার পরিচিত ডাক্তার চাইছিলো, তা আমি তখন বুঝতে পরিনি। বৌ-এর নার্সিংহোমে এ্যাডমিশন হবার পর থেকেই ও ডাক্তারকে, নার্সকে জনে জনে ঐ স্প্যাস্‌টিক বেবির দায় তুলে নেবার জন্যে বা অন্য কোথাও তুলে দেবার জন্যে একটা চ্যানেল করতে চেষ্টা করছিলো। এমনকি মোটা টাকা অফার করতেও পেছোয়নি। আমাকে ডাক্তার বুধাদিত্য রায়ই আমাকে ফোনে সবটা জানালেন। শুনে তো আমি থ। জানি, এই বেবি ওর জীবনে একটা অভিশাপ। কিন্তু তাই বলে এখন থেকেই এমনটা ভেবে বসবে, আর তার প্রস্তুতি নেবে, তা ভাবিনি। ও আমার সম্মানটাও ভাবল না। এখানে আমি সম্মনীয় ব্যক্তি। ভাবলাম, ওর বৌ-ই বা কীরকম মহিলা! কিছু বলছে না!
কিন্তু হলো না। কাউকে পেলো না প্রত্যুষ যার হাতে নিজেকে দায়মুক্ত করার উপায় পাবে। কিন্তু ও যে ভয়ংকর কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। পরে সিজারিয়ান করে প্রত্যুষের বউ-এর ডেলিভারি হতে বুঝলাম ওদের ডাক্তার ঠিকই বলেছিলেন। আমি ওইদিনই শেষবার নার্সিংহোমে গিয়েছিলাম। প্রত্যুষকে দেখে আমি আরো অবাক। ও কিন্তু কোনো বিতর্ক না করে, কোনো সীন ক্রিয়েট না করে একদম চুপ। অনেকটা ঝড়ের আগে যেমন করে আকাশে মেঘ থম মেরে থাকে। প্রত্যুষ বৌ-এর ডেলিভারি করিয়ে নিয়ে চলে গেলো। কিন্তু আমি অবাক হলাম, কেননা এই নার্সিংহোম  থেকে ডিসচার্জ নিয়ে চলে যাবার সময় আমাকে কোনো খবর দেয়নি প্রত্যুষ। ভাবলাম, দেয়নি তো বেঁচে গেলাম। আমি আর গা করিনি, কোনো খবর নেইনি। নেইনি মানে নিতে পারিনি। আমার এ্যাম্বিশন আমাকে ছুঁড়ে দিলো ব্যস্ততার জগতে। মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিলাম, নিজের সন্তানকে স্বচক্ষে দেখার পর হয়তো সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছে প্রত্যুষ। বাবা তো। বাবা না হওয়া পর্যন্ত এক, হলে পরেই সম্পূর্ণ ভিন্ন।
কিন্তু আমার বিয়েতে ওদেরকে নিমন্ত্রণ করতে গিয়ে জানলাম, ওরা শিফ্‌ট করে গেছে। কোথায়, আমাকেও জানায়নি প্রত্যুষ। আশ্চর্য। কিন্তু ভীষণ অবাক হলাম জেনে যে, কী একটা কারণে প্রত্যুষ আর মল্লিকার মধ্যে নাকি সেপারেশন হয়ে গেছে। বাবা-মা হবার পরেই সেপারেশন। কেন, কে জানে। ভাবলাম, জানবারই বা কী দরকার! এ তো আকছার ঘটছে। আমার খুড়তুতো বোনই তো। বিয়ের সাত মাস পরেই ডিভোর্স। কিন্তু আমার চোখে মাঝে মাঝে কেন জানি, প্রত্যুষের বাচ্চাটার একবার দেখা নিষ্পাপ মুখ, ফর্শা ধবধবে চেহারা, আর কচি কচি হাতের একটিতে একটা সুতো দিয়ে টিকিট ঝোলানো নম্বর ২৪ ভেসে ভেসে উঠতো। ঐ ২৪ নম্বরটা বেশ কিছুকাল আমাকে ভুলতে দেয়নি ঘটনাটা। শেষের দিকে স্মৃতিতে শুধু ঐ নম্বরটা ভাসতো। ২৪। মনে মনে বাচ্চাটাকে কমপ্লিমেন্‌টস দিলাম, যা শালী, তোর নাম জানি না বটে। কিন্তু তুই খুব করলি যা হোক। যে বাপ তোকে প্রায় ত্যাগই করেছিলো, সে-ই তোকে দেখা ইস্তক নিশ্চয়ই ফেলতে পারেনি। থ্যাঙ্ক ইউ। একটা পাপ থেকে বাঁচিয়ে দিলি আমার বন্ধুটাকে।


সেই আর এন বোস রোড। আমার প্রজেক্ট এগজিকিউটিভ সমরের এমন ক্ষমতা হয়নি যে, এই সামান্য সময়ের মধ্যে আর এন বোস রোডের প্রায় দু-আড়াইশো ফুটপাথবাসীর রিপোর্ট বানিয়ে জমা দিতে পারবে। আমি বুঝলাম, এটা আমাকেই করতে হবে। কীভাবে একটা বিরাট কাজ ঝটিতি করে ফেলতে হয়, সেই ম্যাজিকটা তো ওর জানার কথা নয়। সমর যে জানে না, সেটা সমর নিজেও জানে। ফলে আমাকেই কাজে নামতে হবে। আমাদের আত্মীয়মহলে বলে দেব সেনশর্মা একটা জ্যান্ত ম্যাজিক। মাটি ধরলেই নাকি সোনা। আমি গোটা বিষয়টা একবার ছকে নিয়ে পরের দিনই হাজীর হলাম আর এন বোস রোডে। চোখে পড়লো সেই লাইফ টাইম নার্সিংহোম।
আমি মনে মনে ঠিক করলাম, এমন কয়েকটা ঘরে আমি আমার কোয়েরিজ চালাবো, যাতে সবকটা ঘরে আমায় ঢুকতে না হয়। এতেই আমি একটা মোটামুটি ফিচার পেয়ে যাবো। একেবারে ছকে বাঁধা কোয়েরিজ। বেছে বেছে একটা একটা করে দুটো ঘর ভিজিট করে শেষে যে ঘরটাতে এলাম, সেই ঘরটা আমাকে ভীষণ আঘাত করলো। লোকটির নাম বীরেন পাইন। দুই মেয়ে আর তিন ছেলের বাপ--- এমনটা বীরেন পাইনের বৌ জানালো। দেখলাম, বিজ্ঞাপনের ঢাউস ঢাউস হোরডিঙ্গ ছিঁড়ে এনে পুরনো ছ্যাচার বেরা দিয়ে ঘর বানিয়েছে। অন্য পাঁচজনের ঝুপড়ির মতোই ঝুপড়ি। একটা ঝুপড়িতেও শৌচকর্ম করবার কোনো ব্যবস্থা নেই। মিনিট কুড়ি হেঁটে গেলেই রেললাইন। সেখানেই প্রাতঃকৃত্য সম্পন্ন করে হয়তো। দেড় হাত চওড়া একটা ফালি বারান্দা পেরিয়ে এক চিলতে ঘর। তাতে কোনো চৌকি-টৌকি নেই। তক্তা পেরেক মেরে পাটাতন বানিয়ে খাট, আর ইট সাজিয়ে খাটের পায়া। পুরনো টালি দিয়ে ছাদ। চারদিকে শুধু পলিথিন আর পলিথিন। বর্ষায় আর ঠাণ্ডায় কীট-পতঙ্গের মতো বেঁচে থাকে ওরা। একটি মেয়ে বাইরে বসে বাসন মাজছিলো। বীরেন পাইনের বৌ আমাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গিয়ে জানালো যে, বীরেন গিয়েছে কাজে। ও মিউনিসিপ্যালিটির ময়লা পরিষ্কার করার কাজ করে। পাড়ায় পাড়ায় ময়লা তুলে এনে একটা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলাই ওর কাজ। আজও তাকে কর্তৃপক্ষ পার্মানেন্ট করেনি। বৌ বাড়ি বাড়ি ঠিকে ঝি-এর কাজ করে। সবে কাজ সেরে বাড়ি ফিরেছে সে। তিন ছিলের দুটি গেছে কাজে। একটি ট্রেনে হকারি করে। আমলকী ব্যাচে। আর একটি কাজ করে একটা চায়ের দোকানে। ছোটটি ঘরের মধ্যে বসে আছে সবচেয়ে ছোট কন্যা সন্তানটিকে আগলে। সবচেয়ে ছোটটি একেবারে ছোট, কিন্তু কত বয়স হবে, কে জানে। বাচ্চাটা বিছানায় শোওয়া। ছেলেটিকে দেখে আন্দাজ করতে হয়। কিন্তু শায়িত বাচ্চাটি দেখে আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। বেশ মনে হল, বাচ্চাটি বোধহয় হ্যান্ডিক্যাপড্‌। তার চেয়ে যেটা আমাকে বেশী করে ঘাবড়ে দিচ্ছিলো, সেটা হল, বাচ্চাটা কেমন যেন হাবে-ভাবে অস্বাভাবিকও লাগছে। একেই বলে স্প্যাস্‌টিক চাইল্ড। এইসব ফুটপাথবাসীদের বাচ্চাদের মধ্যে এই রোগটা তেমন করে আমি আগে পাইনি। ওদের অন্য নানা রোগ দেখেছি। ম্যালনিউট্রিশনের রোগ্‌ পোলিও, বেরিবেরি, আরো এটা ওটা। কিন্তু এই এ্যাবনরম্যালসি দেখিনি। ভাবলাম, হতেই পারে। এটাকেই কেন্দ্র করে আমি আমার স্ত্রীর ভাষায় একটু রেগে গিয়েই মহিলাটিকে বললাম,
--- তোমার একটি মেয়ে আর তিন-তিনটি ছেলে। তবুও তোমাদের আরো একটি সন্তানের কী দিরকার ছিল, বলো তো। আর এমনটা করতে গিয়ে এই রুগ্ন মেয়েটিকে পৃথিবীতে আনলে! আমার তো মনে হয়, একে বিয়ে দিতে পারবে না, একে দিয়ে তুমি কোনো উপার্জন করাতেও পারবে না। কিন্তু কে দেখবে একে? সেটা ভেবে দেখেছো? সামনের বড়ো বড়ো স্কাই স্ক্র্যাপার দেখিয়ে বললাম--- ঐ যে বাড়িগুলো দেখছো, ওখানে এমন রুগ্ন শিশু জন্মালে ওরা দেখতে পারে। ওদের টাকা আছে, পয়সা আছে। তবুও ওরা চায় না, এমন সন্তান ওদের পরিবারে আসুক। তোমরা তো সাধ করে এমনটা করলে। তোমার একটি মেয়ে রয়েছে, তিনটি ছেলে রয়েছে, তবুও...
আমাকে থামিয়ে দিয়ে মহিলাটি যা যা বলল, তাতে আমি যেন পালাতে পারলে বাঁচি। ইতিমধ্যে বড়ো মেয়েটি ওর হাতের কাজ ফেলে, হয়তো বা হাতের কাজ সেরে দরজার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর চোখেমুখে কেমন একটা ভয় ভয় ভাব। মেয়েটির বয়স পনেরো, কি ষোল হবে। সবকটি বাচ্চাই প্রায় এক দেড় বছরের ব্যবধানে জন্মেছে। ছোট ছেলেটি পরম যত্নে তার ছোট বোনটিকে মশামাছি থেকে নিজের হাত আন্দোলিত করে করে করছে। আমাদের ঘরে এইটুকু বাচ্চা একটি ছেলের মধ্যে এই কেয়ারিং বা এই স্নেহময়তা বড়ো একটা চোখে পড়ে না। তারাই তো থাকে আদরে-গোবরে। কিন্তু এই শিশুটি যেন কতটা পরিণত, কতটা সচেতন। আমার সম্বিৎ ফিরল ওদের মায়ের কথায়। সে বলল,
--- বাবু, এই বাচ্চাটাকে দেখুন তো। এবার আমাকে দেখুন। আপনার মনে হয়, এই বাচ্চা, এমন ফর্শা টুকটুকে মেয়ে কি আমার মতো কালো কুশটি মেয়েলোকের পেটে হয়?
আমি কী জবাব দেবো, জানি না। আমি এও জানি না, মেয়েটা এমন বলছে কেন। কী বলতে চায় ও? তাই বলেই দিলাম--- মানে? তোমার ঘরে পালিত হচ্ছে যে বাচ্চা, সে কি অন্য কারোর নাকি? আর ওভাবে কে কালো কুশটি, আর কে ফর্শা টুকটুকে--- তা তো বিচার করা যাবে না। আর আমি পুলিশও নই, যে তোমাকে এ্যারেস্ট করবো। আমি তো জানতে চাইছি। তুমি বলো।
মেয়েটা একবার বড়ো মেয়েটির দিকে, একবার নিজের ছোট ছেলেটির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল--- আমি এই বাচ্চাটাকে আজ দু বছর ধরে পালছি। এর বয়স দুই বছর।
আমি হতবাক। পালছি মানে! তাই বললাম--- পালছো? তুমি কি দত্তক নিয়েছ নাকি? কিন্তু কেন গো মেয়ে? তোমার সন্তান থাকতে আবার দত্তক নিতে গেলে কেন? 
মুচকি হাসে বীরেনের বৌ। বলে--- দত্তক! এমনিতেই নিজেদের ছেলেমেয়ে পালতে পারি না। আবার দত্তক নেব কীভাবে, বাবু?
--- তবে? 
এবারে মহিলা আমার পায়ে পড়ে আর কি। হাতজোড় করে বলে--- বাবু, আপনাকে আমরা চিনি। আপনি আমাদের ঘরের বাচ্চাগুলোর জন্যে অনেক কিছু করেন। আমি সত্যি বলছি, আমি এই বাচ্চাটাকে কিন্তু চুরি করিনি।
চুরি যে ওরা করেনি, সে আমিও জানি। চুরি করে করবেটা কী? চুরি করে বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া তো আর কোনো কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু বিক্রি যে করেনি, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হল, এই বাচ্চা কেউ কিনবেই বা কেন? তবে? মেয়েটি নিজেই উত্তরটা দেয়,
--- একে আমার বড়ো ছেলে পিলু ঐ নোংরার মধ্যে কুড়িয়ে পায়।
--- কুড়িয়ে পায়, মানে!
--- সকালে উঠে দাঁতন মাজতে মাজতে ঘাট করতে যাচ্ছিলো। সেই সময় ঐ নোংরার মধ্যে একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। একটা তোয়ালে দিয়ে জড়ানো ছিল। নিশ্চয়ই কোনো বড়লোকের বাড়ির মেয়ে হবে। পিলুর তো ঘাট যাওয়া মাথায় উঠলো। বাচ্চাটাকে এনে হাজীর করলো বাড়িটতে। ওর বাবা তো কিছুতেই রাখবে না। কার না কার বাচ্চা! থানা পুলিশ হবে। অনাথ আশ্রমে দিয়ে দেবে। কিন্তু অনাথ আশ্রম যে কোথায় আছে, তা তো চিনি না। অনেক কান্নাকাটি করে ওর বাপকে রাজী করালাম। সেই থেকে ও আমাদের কাছেই আছে। আমার ছেলেমেয়েরা ওকে খুব ভালোবাসে। কোন বাড়ির বাচ্চা, আমরা জানি না। কেউ কখনও এই বাচ্চাটাকে খুঁজতেও আসেনি।
মায়ের কথাটাকে কেটে দিয়ে সবশেষে বড়ো মেয়েটি বলে উঠলো--- বাচ্চাটার হাতে একটা টিকিট লাগানো ছিল। তাতে লেখা ছিল ২৪
আমি যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলাম। ২৪! ও মাই গড! ২৪! আবার সেই ছোট্ট অবুঝ আর নিষ্পাপ একটা ২৪ লেখা সদ্যজাত শিশুর হাতের ছবি আমার চোখের সামনে ফুটে উঠলো। আমি ওদেরকে কী বলবো? আমি কী-ই বা করবো? কাঁদবো, না আনন্দে ফেটে পড়ব, নাকি লজ্জায় সেখান থেকে পালাব? আমি। আমি এসেছি ওদেরকে জীবনের সন্ধান দিতে, একটু নিশ্চিন্ততার আলো দেখাতে। আমি কি জানি, সুখ কী? আনন্দ কী? জীবন কী? কাকে আমি আলো দেখাবো? কোন আলো? আলোর সন্ধান আমি কি আদৌ জানি? নিজেকে সামলে নিয়ে একটু জোর করে হেসে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম,
--- ওর নাম কী? কী বলে ওকে ডাকো?
লজ্জায় গুটিয়ে গিয়ে দজারটাতে অকারণে কি একটা খুঁটতে খুঁটতে পঞ্চদশী উত্তর দিলো--- রাজকুমারী। আমার ভাই ওর নাম দিয়েছে। ওকে কি সুন্দর দেখতে! তাই আমরাও ডাকি রাজকুমারী
আমি মনে মনে ভাবি, সত্যিই তুই রাজকুমারী রে। নরক থেকে স্বর্গে এসেছিস। আমরা পারিনি। নরকেই আছি। অনেকগুলো কবিতার ছত্র, উপন্যাস আর প্রবন্ধের নানা বাক্য চোখের সামনে ভেসে ভেসে উঠছিলো। কিন্তু বাস্তবের সামনে সেগুলো জেনও ফিকে লাগছিলো। আমি বুঝলাম, এই গ্র্যান্ট-টা আমার পাওয়া হচ্ছে না। আমাকে আবার নতুন করে গোছাতে হবে। সব গোছাতে হবে। আমার শিশোকে গোছাতে হবে। নাই বা পেলাম গ্রান্ট। ওরকম কত গ্রান্ট আসবে, যাবে! আমি এই রাজকুমারীর ঘর থেকেই সব নতুন করে শুরু করবো। কাগজ-পত্র গুটিয়ে-বাটিয়ে ওদের ঘরের বাইরে এসে প্যান্টের দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে আর আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা পবিত্র শ্বাস নিতে খুব চেষ্টা করলাম। কিন্তু এই বস্তির বাইরে কোথায় সেই পবিত্র শ্বাস?

------------------------